বাপ্পী সরকার: মানুষের সুকোমল হৃদয়বৃত্তির বহিঃপ্রকাশ ঘটে যে বিশাল সাহিত্যভাণ্ডারে তার আনন্দ ভোজসভায় প্রেম, প্রকৃতি, সুখ-দুঃখ, বিরহ-মিলন, ধনী-গরীবের ব্যবধান, প্রেমিক যুগলের হৃদয়ানুভূতি, ইত্যাদি বিষয়ভিত্তিক উপাদেয় ও লোভনীয় মজাদার খাবার হিসেবে দেশী-বিদেশী অনেক পরিবেশনা থাকলেও পেশাদার চার্টার্ডঅ্যাকাউন্ট্যান্ট মোঃ সিরাজুল ইসলাম এফ.সি.এ.-র আগে প্রায় নিরস ও একঘেয়ে নামে জনারণ্যে পরিচিত হিসাববিজ্ঞান পেশায় নিয়োজিত নায়কের নিজস্ব জীবন-সংগ্রাম, হাসি-বেদনা, ব্যক্তি-পরিবার-সমাজবোধ, প্রেম-প্রীতি, মায়া-মমতা, দেশাত্মবোধ, অসাম্প্রদায়িকতা, গণমানুষের ঐকান্তিক ভালবাসা, সামাজিক শোষণ-নিপীড়ন, পারস্পারিক শ্রদ্ধাবোধ, বুকভরা কৃতজ্ঞতা, সরল গ্রাম্য ও বর্ণাঢ্য শহুরে জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত, জীবন যাপনের বৈচিত্র, রুঢ় বাস্তবতা, পেশাগত দায়িত্ব-কর্তব্যবোধ, নীতি-নৈতিকতা, চিরন্তন প্রকৃতির রুপ-মাধূর্যের নৈসর্গিক বর্ণনা বহমান নদীস্রোতের মত পাঠককে ভাসিয়ে নিয়ে যায় অসীম ও অজানা জ্ঞানসমুদ্রের বেলাভূমিতে –বুভুক্ষপাঠক সাহিত্যের অমীয় সুধায় বিভোর হয়ে পড়ে পাঠ-তৃঞ্চায়; ভুলে যায় ক্ষুৎ-পিপাসা; অনেক সময় এক বৈঠকেই বইটা শেষ করে তৃপ্তহয় পাঠক মন । পরতে পরতে চমক আর অনাগত দৃশ্যপট কল্পনায় সন্মুখে এগিয়ে চলেন সতৃঞ্চ পাঠক!
পাঠ শেষে মনে হয়, “….এই কি গো তব শেষ গান/শুরু কেন হয়েছিল, যদি হবে অবসান” চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট(সিএ)-দের জীবন গল্প সিরিজের প্রথম বই ‘হিমালয় পেরিয়ে’ দ্বিতীয়টার নাম “হিমালয় পেরিয়ে নবদিগন্ত” আর তৃতীয়টা “অনন্ত আকাশে” । প্রতিটা বইতে নতুনভাবে জীবনলব্ধ অভিজ্ঞতার বিরল ছাপ বিদ্যমান! যা দুষ্প্রাপ্য, দুর্লভ ও অমূল্য ।
ইতিপূর্বে পাঠক অনেক বিচারক, পুলিশ, সাংবাদিক, জেল কর্মকর্তা, রহস্যানুসন্ধানী (গোয়ন্দা), পরিব্রাজক, শিকার, রাজনীতিবীদ, রাষ্ট্রনেতা, আইনজ্ঞ, বিজ্ঞানী,……প্রমূখ পেশাজীবী সাহিত্যিকের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় লেখা বই থেকে অজানা কাহিনী পড়ে চমৎকৃত হয়ে থাকলেও খুব কম ক্ষেত্রে (এমনকি নেই বললেই চলে!) হিসাববিজ্ঞান ও আর্থিক পেশাভুক্ত কোন সু-সাহিত্য কর্ম অধ্যয়নের বিরল সুযোগ লাভ করেছেন । এদিক দিয়ে হিসাব শাস্ত্রের অনেক প্রায়োগিক ও জটিল ব্যবসা-বাণিজ্য সংক্রান্ত রীতি-নীতি তথা কৌশলগত পদ্ধতি গ্রহণ ও সিদ্ধান্তবিষয়ক বাস্তব বিষয়াবলী সোজা-সাপ্টাভাবে অত্র লেখকের বাস্তব অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানের আলোকে আলোচ্য বইগুলোতে জায়গা করে নিতে পেরেছে ।
লেখক কালোকে সাদা বলেননি কখনো, বিন্দু পরিমাণ নীতিভ্রষ্ট হননি কস্মিনকালেও; তিনি দেখিয়েছেন কিভাবে সততা, নিষ্ঠা ও ঐকান্তিক পরিশ্রমের জোরে একজন অতি সাধারণ, সরল পশ্চাদপদ গ্রাম্য উৎসাহী যুবক অভূতপূর্ব সাফল্যের চরম সীমায় পৌঁছাতে পারে; হতোদ্দম না হয়ে নিরলস পরিশ্রমের মাধ্যমে কিভাবে স্ব-প্রতিষ্ঠিত হয়ে মানুষ সামাজিক দায়িত্ব সচেতন ও বিবেকবান সুনাগরিকে পরিণত হয় – তার দায়িত্ব ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, দেশ ছাড়িয়ে বৃহত্তর পরিমণ্ডলীতে পরিব্যপ্ত হয় ।
প্রকৃতপক্ষে সিএ’দের হিমালয় পর্বতের মত দুর্লঙঘ ও কঠিন সংগ্রামমুখর জীবনালেখ্য ভিত্তিক চালচিত্র (আপাততঃ) পূর্বোক্ত তিন খণ্ডে বিভক্ত ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরা হয়েছে; দেখানো হয়েছে সিএ কোর্সে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাওয়া, বঞ্চনা, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের শিকার হওয়া থেকে শুরু করে পাশের আগে বার বার ব্যর্থতাজনিত হতাশার দুঃসহ ও করুণ চিত্র! অর্থনৈতিক দৈন্য ও শারীরীক কষ্টের দৃষ্টান্ত, অব্যাহত প্রচেষ্টা সহ নিরলস সাধনা এবংচূড়ান্ত সাফল্য অর্জন (সিএ পাশ) নামক ‘সোনার হরিণ’ সদৃশ্য কৃতিত্ব ও ভাগ্যোন্নয়নের চাবিকাঠি প্রাপ্তির দুর্লভ সৌভাগ্যের তালচিত্র । পৃথিবীময় সিএ পাশ লোকের সংখ্যা অন্য পেশাজীবীর তুলনায় নিতান্তই কম এবং শিল্প-বাণিজ্য ক্ষেত্রে এর ব্যাপক চাহিদা থাকায় অর্থনীতির সূত্রানুসারে এ পেশাধীন লোকের যোগান কম হওয়ায় তাদেরকদর ও বাজার মূল্য স্বাভাবিকভাবেই বেশি, ফলে তারা ব্যাপক নিয়োগ-সুবিধা সহ অন্যান্য সুযোগ লাভের যোগ্য বিবেচিত হন । এ সকল বিষয়গুলো উক্ত গ্রন্থগুলোতে গল্পকথার আকারে উঠে এসেছে ফলে বিশেষ শ্রেণীর পাঠক মহলে এ পেশার প্রতি আগ্রহ ও উৎসাহ উদ্দীপনার উন্মেষ সৃষ্টি হয়েছে ।
আপাততঃ প্রাগুক্ত গল্পগ্রন্থ ত্রয়ের কল্পিত নায়ক ‘রিহান’ লেখকের এক অনন্য সৃষ্টি – তিনি আদর্শবান উদ্দমী যুবক, সহনশীল, প্রেমময় হৃদয়ের অধিকারী, সংবেদনশীল, পরিশ্রমী ব্যক্তিত্বের ‘মডেল’ । রিহানের মধ্য দিয়েই প্রতিষ্ঠিত হয় স্নেহ-মায়া-মমতা-প্রেম, মাতৃ ভক্তি, সমাজ সচেতনতা, ধার্মিকতা, ইত্যাদি; লেখক নায়ক রিহানকে সৃষ্টি করেছেন, গড়ে তুলেছেন হৃদয়ের মাধুরী মিশায়ে তাঁকে আদর্শবান সন্তান, স্বামী, সামাজিক নেতা তথা সুনাগরিক হিসেবে, চিত্ত ও বিত্তে দিয়েছেন অর্থ-প্রাচূর্য-মান-মর্যাদার যথাযোগ্য প্রাপ্য অধিকার । রিহান ম্যাকিয়াভেলীর সুবিধাবাদী “দ্য প্রিন্স” নন, তিনি লেখকের কল্পনার বরপুত্র! জয়তু লেখক । দীর্ঘজীবী হোক নায়ক রিহান, আমরা তাঁর উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি সহ লেখকের অব্যাহত সাফল্য কামনা করি ।
পর্যালোচনাধীন বইগুলোর লেখক মোঃ সিরাজুল ইসলাম এফসিএ একাধারে ঔপ্যনাসিক, কবি, সু-সাহিত্যিক ও গল্পকার; গুলশান, ঢাকার একটা লব্ধপ্রতিষ্ঠিত  প্রসিদ্ধ গ্রুফ অব্ কোম্পানীর চীফ ফিনান্সিয়াল অফিসার (সিএফও) । অফিসিয়াল শত কর্মব্যস্ততার পাশাপাশি তিনি নিরলসভাবে অকাতরে সাহিত্য সেবা করে চলেছেন; সিএ’দের জীবননির্ভর গল্পগ্রন্থ ছাড়াও ২০১৭ সাল থেকে অদ্যবধি (এপ্রিল,২০২১) তাঁর কবিতাগ্রন্থ ‘মরুর পথে’, রোহিঙ্গাদের জীবনভিত্তিক বাংলা গল্প কাহিনী ‘সীমান্তের ওপারে’ (যার ইংরেজী অনুবাদ Beyond the border), বৈজ্ঞানিক কল্প কাহিনী (সায়েন্স ফিকশন) ‘ভিন্ন সময়ে ভ্রমণ’, পত্র উপন্যাস ‘হৃদয়ের প্রান্তে’,সুন্দরবন সংলগ্ন দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম এলাকার নিত্য বানভাসী উপকূলীয় মানুষের অসহ দুঃখভরাক্রান্ত জীবন-যন্ত্রণার উপন্যাস ‘নিঃসঙ্গ মোহনায়’, ‘বিবর্ণ প্রহরে’ ‘শিশর ভেজা পথ’, ‘হৃদয়ের গভীরে তুমি’ ইত্যাদি নাম শীর্ষক মোট ১৫টা বই ঢাকার অমর প্রকাশনী (মোবাইল ফোন: +৮৮ ০১৭১২ ৫৭৮ ৬৫৯), অন্য প্রকাশ, প্রভৃতি থেকে প্রকাশিত হয়েছে । সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রেক্ষাপটে রচিত প্রতিটা বইতে স্পষ্টতঃই স্বতন্ত্র বৈশিষ্টের স্বাক্ষর প্রতিফলিত হয়েছে যা পাঠককে দিয়েছে অভূতপূর্ব অনুভূতির স্বাদ ।
এ লেখকের গতিশীল, সহজ-সরল অথচ শক্তিশালী লেখনীতে সম্পূর্ণ নিজস্বতার ছাপ ফুটে উঠেছে; কখনো কাহিনীর ধারাবাহিকতা নিয়ে অন্যদের মনে ভিন্ন মতামত থাকলেও তিনি তাঁর সৃষ্ট পটভূমির নিপূণতা ও প্রাসঙ্গিকতা সহজাত বিনয়ের সাথে উপস্থাপন করেছেন তবে সন্দিহান সমালোচকের মতামতের ভিত্তিতে তাঁর নিজস্ব সৃষ্টিকৌশল ও প্রেক্ষাপট থেকে বের হয়ে আপোষ করেননি কখনোই – এটাই তাঁর সৃষ্টিগত মৌলিকত্বের সাক্ষ্য বহন করে । প্রত্যেক শিল্পীই তাঁর নিজস্ব সৃষ্ট জগতের একক এবং অনন্য স্রষ্টা, সৃষ্টিতেই তাঁর অবিরল আনন্দ, অবিচল আস্থা । অমর সাহিত্য সৃষ্টির লক্ষে সিরাজুল ইসলাম প্রকৃতির অপার আনন্দ আস্বাদন, উদ্ভূত পরিস্থিতি অবলোকন, বিচিত্র মানব চরিত্র অধ্যয়ন ও কাহিনীর প্লট খোঁজার জন্য বার বার নিজ গ্রাম সহ বিশ্বের অন্যান্য দেশও ভ্রমণ করেন । প্রত্যেক কবি-সাহিত্যিকের সৃষ্টিকর্মের উৎস হিসেবে পিছনে থাকে ব্যক্তিগত জীবনোপকরণ ও অনুপ্রেরণা; সৃষ্টকর্মে থাকে যার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অবদান । অনেকেই সাহিত্য রচনায় উদ্যোগী হলেও পর্যাপ্ত সৃজনশীল দৃষ্টিভঙ্গির অভাবে তাদের সে প্রচেষ্টা পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হয় না ।